শাহরুখ সমাচার

শাহরুখ সফল না কিভাবে? তার ছবি পয়সা কামায় না নাকি সে ভালো গল্পের ছবি দিতে পারে না? গত ২/৩ বছরে বলিউডি সিনেমার বৈসাদৃশ্যের যে চিত্র পাওয়া যায়, সেখানে শাহরুখের এখনকার সিনেমাগুলোর অবস্থান দুইভাবেই বিপরীত। বিশেষকরে ‘অক্টোবর’ ও ‘তুম্বাড়’ সিনেমার দর্শক পাওয়া দেখে বুঝে নিতে হয় বলিউডি দর্শকের চাহিদায় ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকা কন্টেন্ট নির্ভর সিনেমা জায়গা করে নিচ্ছে। তবে এই দুই সিনেমার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল ছবির বিষয়ের প্রতি সৎ থাকা। তাই স্ক্রিপ্টের চাহিদা বুঝে তৈরি হয়েছে ফিল্মের বাজেট ও প্রোডাকশন। অন্য কোন ফ্যাক্টরের কারণে স্ক্রিপ্টের গুরুত্বে আপস আসে নি।

‘জিরো’ দেখে তাই মনে হয়, ছবির প্রোডাকশন সেটআপ করে সেখানে গল্প ফেলা হয়েছে। স্ক্রিপ্ট না, মনোযোগ সব খরচ হয়েছে ছবির স্কেল বড় করতে। যেটা আনন্দ এল রাই ও হিমানশু শর্মার শক্তির জায়গা না। তাদের শক্তির মূল জায়গা যেখান থেকে তারা ওঠে আসছেন- ছোট শহর আর মধ্যবিত্ত পরিবার। ছবিটা তাই তাদের কমফোর্ট জোনের বাইরে। তবে এটা একমাত্র কারণ না। ছবির স্ট্রাকচার বলে দেয় ছবিতে ফোকাস গ্রুপের সম্পৃক্ততা ভালোভাবে আছে। ফোকাস গ্রুপের কাজ কি? সিনেমার হিট পয়েন্ট বের করে দেয়া হল তাদের কাজ। তাই এরকম চিন্তাভাবনা থেকে এমন কনফিউজ কাজ বের হয়ে আসা খুবই স্বাভাবিক।

পেছন ফিরলে, রোহিত-ফারাহ খপ্পর থেকে বের হয়ে শাহরুখের পরের পাঁচ ছবিতে পর্যায়ক্রমে এইপরিচালকগণের (মনীশ শর্মা-গৌরি শিন্ডে-রাহুল ধোলাকিয়া-ইমতিয়াজ আলি-আনন্দ এল রাই) নাম দেখতে পারা তার ভক্তসমাজে যতটা স্বস্তি এনে দিয়েছিল, এখন বোধকরি তার অবশিষ্ট নাই। কাজেই এই টানা ব্যর্থতায় আপনি কারে ডিফেন্ড করে আলাপ বাড়াতে চান? শাহরুখকে না তার ছবির পরিচালকদের? সমস্যা হচ্ছে এই পরিচালকেরা যখন শাহরুখ বা তার প্রোডাকশনে যুক্ত হচ্ছেন তখন স্ক্রিপ্ট থেকে চরিত্র বড় হয়ে যাচ্ছে, মূলগল্প যেমনই হোক একে টেনে বড়-বাজেটের সিনেমায় রূপ দেয়া হচ্ছে। গল্পের শক্তি চিন্তার বিষয় না হয়ে, সব চিন্তা আটকে যাচ্ছে সব শ্রেণীর দর্শককে (মাল্টিপ্লেক্স-সিঙ্গেল স্ক্রিন) খুশী করা যাবে কিনা। বড়-বাজেটের সিনেমায় রূপ দেয়ার পেছনের ইচ্ছাটা কেবলই মোটা অঙ্কের প্রফিট করতে চাওয়া। এই ‘সব ধরনের দর্শক’ খুশী করার রোগে বলিউডের প্রায় ৯০ ভাগ ছবি আক্রান্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্য শাহরুখের এই রোগমুক্তি এখনও মেলেনি। সেজন্যে ফ্যান-রাইজ-যাব হ্যারি মেট সেজাল-জিরো ছবিগুলো একই দোষে দুষ্ট। আপনি যখন শাহরুখ-ইমতিয়াজের কলাবোরেশন দেখেন, তখন আশা করেন শাহরুখের ছবির মেলোড্রামা বিয়োগ আর ইমতিয়াজের ইনডিভিজুয়ালিটি যোগ হয়ে একটা ব্যালেন্স কিছু দাঁড়াবে। খেয়াল করে দেখুন হ্যারি চরিত্রের দ্বন্দ্ব তার অন্য ছবির মতোই- একটা কনফিউজ মানুষ কোন একটা জার্নির মধ্য দিয়ে যেয়ে জীবনের মানে খুঁজে পাবে। কিন্তু এই চরিত্রের ডেভেলপ ব্যতীত সামগ্রিকভাবে ছবিটা কিছু দাঁড়ায় না। সমস্যাটা দুইরকমই হতে পারে- ইমতিয়াজের আনডেভেলপ স্ক্রিপ্ট বা শাহরুখের প্রোডাকশনের হস্তক্ষেপ। রাহুল ধোলাকিয়ার ছবিতে, দর্শক হারাবার ভয়ে শাহরুখ স্ক্রিপ্টে থাকা সব গালিগালাজ কেটে দেন। এতে করে গল্পের টোনে ব্রেক পড়ে ছবি তার মূল বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। এই ছবিগুলোর মধ্যে মনীশ শর্মার ছবিটা তার বিষয়ের দ্বন্দ্বে অনেকটা উৎরে যায়। কিন্তু পুরো ছবিতে ওই সব ধরণের দর্শক টানার টেনশন ঠিকই টের পাওয়া যায়। যখন উদ্দেশ্যই ভুল তখন ‘প্রতিটা ছবির সেকেন্ড হাফ দুর্বল’- এই সমস্যাকে সামনে এনে দেখার সুযোগ নাই। যেহেতু, গৌরি শিন্ডে ছাড়া, এদের প্রত্যেকের ভুলের পরিমাণ শাহরুখের সাথে কাজ করতে গিয়ে বেড়েছে তাই এই ব্যর্থতার দায় শাহরুখ ও তার প্রোডাকশনকেই নিতে হবে। অন্যদিকে, ‘শাহরুখ-দ্য স্টার’ সামলাতে না পারা ওই পরিচালকদের ব্যর্থতা।

এটা ঠিক, একজন নতুন অভিনেতা তার অভিনয়-ক্যারিয়ারের প্রত্যেকটা ছবি পছন্দ করে নিতে পারে না। সে ওই ছবিগুলোতেই শেষে যুক্ত হয় যেগুলো তাকে অফার করা হয়েছে। তবে সে তার অভিনয়দক্ষতা দিয়ে একটা ইমেজ তৈরি করতে পারে যাতে বছরের ভালো ছবিগুলোতে তাকে অফার করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও, মারলন ব্র্যান্ডোর মতো গ্রেট অভিনেতার ক্যারিয়ারও একগুচ্ছ গ্রেট ছবি দিয়ে সাজানো না, সেই ক্যারিয়ারও শর্তসাপেক্ষে দাঁড়ানো। শর্তগুলো কখনো লাইফস্টাইল বজায় রাখার রোজগার, কখনো একেবারে ক্রিয়েটিভ স্যাটিসফ্যাকশন। তাহলে তো এই প্রসঙ্গের উল্লেখ হয়ে যায় শাহরুখের বর্তমান পর্যায়কে জাস্টিফিকেশন দেয়া। কিন্তু মূল পয়েন্টও এখানে। শাহরুখ ক্যারিয়ারের এমন একটা পর্যায়ে আছে যেখানে তার পছন্দমতো ছবিতে যুক্ত হবার পাওয়ার ও পজিশন দুটোই আছে। উপরের ৫ ছবির ৪টিতে প্রডিউসার হওয়া তাই বলে। কাজেই ক্যারিয়ারের স্বার্থেই শাহরুখের উচিত, কন্টেন্ট সিনেমার সাথে সুর মিলিয়ে নিজের স্টারপাওয়ার ব্যবহার করে দর্শকের রুচি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা। তার সমসাময়িক আমির খান যেটা বছরের পর বছর করে যাচ্ছেন।

গোটা ছবি দেখতে না পারা- অভিনেতা শাহরুখের দুর্বলতা। স্ক্রিপ্ট বাছাইয়ে তাই গোটা ছবিকে প্রাধান্য দিয়ে শাহরুখের উচিত পরিচালকের ইন্টারপ্রিটেশনে নিজেকে সঁপে দেয়া। একদম সঠিক অপশন না হলেও, এসবের মাঝে একটা উপায়ন্তর হতে পারে- গৌরি শিন্ডের ‘ডিয়ার জিন্দেগি’ গোটা ছবিতে ‘ডক্টর জাহাঙ্গির খান’ চরিত্রের সংমিশ্রণ। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত, অভিনেতা শাহরুখকে ব্যবসায়ী শাহরুখ থেকে যেকোনভাবে আলাদা হতে হবে। কোটি টাকার ভিএফএক্স আর পাঁচ ঘন্টার মেকআপ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রয়োজনীয়, যতক্ষণ গোটা ছবি প্রাধান্য পাচ্ছে। শাহরুখের মত স্টারেরা যেপরিমাণে স্টারডম উপভোগ করে থাকেন সেটা হারাবার ভয় তাদের সবসময় থাকেই। স্টারডম একটা বাবলের মতো, প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা এই বাবলের বাইরে যেয়ে ভাবতে পারেন খুব কম স্টারেরা। আর তাই যতদিন না শাহরুখ এই স্টারডমের মোহ থেকে বের হতে পারবেন, ততদিন অভিনেতা শাহরুখকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

● লেখার সময়কাল ও স্থানঃ ডিসেম্বর ২০১৮, সিলেট।


Leave a comment